
‘কবিতাপত্র’-এর সম্পাদক হোসেন দেলওয়ারের সাথে কে আমায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেটা মনে পড়ছে না। সম্ভবত আমাদের সবচেয়ে ‘তরুণ’ বন্ধু অনন্ত সুজন। কিভাবে যে, তাও মনে নেই। গত পরশু দেলওয়ার ভাই কল দিয়েছিলেন। শুক্রবার কবিতাপত্রের একযুগ পূর্তি, সেই অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ জানাতে। রাস্তায় ছিলাম বলে অল্পই কথা হলো। পরে বাসায় ফিরে যখন ফোনের কল-লগ ঘাঁটতে লাগলাম, মনে পড়ল আবার সেই দেলওয়ার ভাইয়ের কবিতাপত্রের কথা।
এক যুগ। বারো বছর একটা কাজ টানা করে যাওয়া, নিজের তেমন কোনো লাভালাভ না ভেবে, কিছু না পেয়ে; এটা আমাকে কিছুটা হলেও ভাবায়। পেশায় ডাক্তার একজন মানুষ, প্রচুর রোগী যার চেম্বারে [একদিন আমি, সোহেল হাসান গালিব আর অনন্ত সুজন রাত ১০টার দিকে তার চেম্বারে গিয়ে দেখি তখনো প্রায় একশ রোগী অপেক্ষমাণ] তার পক্ষে একা হাতে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার মতো একটা অসম্ভব পরিশ্রমের কাজ এতদিন ধরে চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। অবশ্য এটা কখনো জিজ্ঞাসা করা হয় নি, কবিতাপত্রকে তিনি লিটল ম্যাগাজিন ভাবেন কিনা।
কবিতার প্রসঙ্গ এলেই তার একটি কবিমন কথাবার্তায় দেখতে পেয়েছি, যেটা সম্পাদকদের মাঝে সাধারণত দেখা যায় না।
সাহিত্যপত্রিকা হিশাবে কবিতাপত্র কী কী করতে পারল, করা উচিত, সে-বিষয়ে আমি অবশ্যই যাব না। কোনো মূল্যায়ন নয়, সেটার দরকারও নেই। আমি শুধু কবিতাপত্রের দেলওয়ার ভাইয়ের সাথে আমার কয়েকটা স্মৃতি [যতটুকু মনে পড়ে] শেয়ার করব।
১. আট বা নয় সালের দিকে, ততদিনে কবিতাপত্রের ২/৩টা সংখ্যা হয়ে গেছে। অনন্ত সুজন আমার কাছে লেখা চাইলেন কবিতাপত্রের হয়ে, আমি জিজ্ঞাসা করলাম সম্পাদক কে? উনি জানালেন হোসেন দেলওয়ার। তখন আবার আরেক যুগ, লেখা দেয়ার আগে দেখতে হয় সম্পাদক জামাত-শিবির করে কিনা! তো আমি উনাকে দেখতে সুজনসহ একদিন গেলাম শিশু হাসপাতালে। গিয়ে দেখি, তার চেয়ারের পাশে একটা নিচু জায়গায় এবং তার ব্যাগে অনেক কবিতার বই। তার নয়, অন্য কবিদের। নানান বই থেকে নানান কবিতা পড়ছেন, প্রশংসা করছেন। আমি একটু অবাকই হলাম। এ যুগে তো কেউ কারো প্রশংসা করে না। অন্তত বাংলাদেশে কবিতা লিখে পেছনে গালি খেলেই সেটাকে এখনকার সেলিব্রেটিরা প্রশংসা মনে করেন। আর এই লোক তো প্রশংসা করছেন! আমি আসলে খুবই অবাক হয়েছিলাম সেদিন। এরপর যতবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে; কবিতার প্রসঙ্গ এলেই তার একটি কবিমন কথাবার্তায় দেখতে পেয়েছি, যেটা সম্পাদকদের মাঝে সাধারণত দেখা যায় না। ঘ্রাণে যেমন ভোজনের অর্ধেকটা হয়ে যায়, সম্পাদকদের রুচিটাও সাধারণত দিনে দিনে এমনই হয়। দেলওয়ার ভাই এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, সেটা আমি সেদিনই টের পেয়েছিলাম।

২. সেটা ২০০৯/১০ হবে। বাজারে দেলওয়ার ভাইয়ের একটা বই এসেছে। ১৬ বা ২৪ পৃষ্ঠার। দূরে থাকি বলে বা আমাকে অত ফোনে পাওয়া যায় না বলে আমি জানতে পারি নি। বইমেলায় গিয়েছিলাম, যেহেতু দেলওয়ার ভাই জানান নি, আমি জানতেও পারি নি। তো আমি সেই বইয়ের খবর জানতে পারলাম ১/২ বছর পর। একদিন ফোনে উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন জানালেন না বইয়ের কথা? ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারলেন না। বুঝলাম, লজ্জায় জানাতে পারেন নি। আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। বাংলাদেশের কোনো সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদকের এতটা লজ্জা, সেটা আমি প্রথম দেখলাম। এদেশে সম্পাদকেরা সাধারণত একটা বই করার আগে কোন কোন চ্যানেলে প্রচার করা যায় সেটার পরিকল্পনা করেন। একজনকে দেখেছি কয়টা রিভিউ হবে, সেটা তালিকা করে লেখকদের ফোন দেয়া শুরু করেছেন। আমি এটা উনার কাছ থেকে দেখি নি। তার নিজের লেখাকে বাজারে ম্যানিপুলেট করার ইচ্ছাটা আমার চোখে কখনো ধরা পড়ে নি। ফলে কিভাবে যেন একটা শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর ইনভল্ভমেন্ট যতটুকু তার সাথে, ঠিক এই কারণেই।
৩. কবিতাপত্রের সংখ্যাগুলো লক্ষ করলে দেখা যাবে, এটা এখন পর্যন্ত কারো প্রোপাগান্ডা মেশিন হিশাবে কাজ করে নি। ঢাকা শহরে এ এক বিরল ব্যাপার। দেলওয়ার ভাইয়ের সম্পাদনাটা সব সময়ই ইনক্লুসিভ। মাঝে মাঝে ফোনে বলতেন, অমুক কবির কবিতা ভালো লেগেছে, তার থেকে কবিতা আনতে হবে। অমুকের গদ্য খুব ভালো, গদ্য আনতে হবে। আমাদের বন্ধু কবি রাশেদুজ্জামানের বই বের হওয়ার বছর সেটা, ৬/৭ বছর আগের কথা। দেলোয়ার ভাই ২/১ দিন পর পর আমাকে ফোন দেন, জানতে চান বইটা আসছে কবে। সেই পাণ্ডুলিপি থেকে নানান পঙ্ক্তি পড়ে শোনান। আমি ফাঁকে ফাঁকে ভাবি, কী পাগলা কবি রে। মজার কথা হলো, এ কাজগুলো তিনি এখনো করে থাকেন। আগের মতোই। কোনো পরিবর্তন নেই!
৪. নিজের পত্রিকার পাশাপাশি অন্যদের পত্রিকা নিয়েও সমান ভালো লাগা, খারাপ লাগা দেখেছি তার মধ্যে। অন্যান্য সাহিত্যপত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া, তাদের ভালো দিকগুলো, অপছন্দের দিকগুলো নিয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখা, তা অকপটে বলতে পারার লোকটির নামই হলো হোসেন দেলওয়ার।
এ শহরে এখনো একজন সম্পাদক আছেন যিনি নিজ উদ্যোগে নবীন, প্রবীণদের লেখা জোগাড় করে পড়েন, ভালো লাগলে তার পত্রিকায় লেখার আমন্ত্রণ জানান।
কার লেখা ছাপবেন, কারটা ছাপবেন না, এটা নিয়ে কখনোই খুব সিলেক্টিভ হয়তো নন তিনি। আমার মতে এটা ভালো। এতে বিচিত্র ধরনের কবি-লেখকদের একসাথে পাওয়া যায়। প্রচলিত হেজিমনিগুলো কিছুটা হলেও চাপে পড়ে। আর সবচেয়ে বড় কথা, তরুণরা কিছুটা স্পেস পায়। কবিতাপত্র ঘাঁটলে দেখা যায়, তরুণদের অনেক বেশি স্পেস দিয়েছেন দেলোয়ার ভাই। অনেক তরুণ কবি বা গল্পকারের প্রথম লেখা কবিতাপত্রই প্রথম ছেপেছে। দেলওয়ার ভাই এগুলো ছেপেছেন শুধুমাত্র ভালোলাগা থেকে। এর বাইরে তেমন কোনো হিশাব কাজ করে নি বলেই আমার বিশ্বাস। হোসেন দেলওয়ারের এই সব বৈশিষ্ট্যই মনে হয় তার পত্রিকা কবিতাপত্রের একটা চরিত্র আমাদের মধ্যে দাঁড় করিয়েছে।
কিন্তু আমি কেন এ নিয়ে লিখতে বসেছি! ঢাকায় যেসব প্রিন্টেড সাহিত্যপত্রিকা আছে, এবছর প্রায় সবারই বড় বড় বর্ষপূর্তি আছে, বিরাট আয়োজন আছে। কবিতাপত্রের যুগপূর্তির আয়োজন তাদেরকে ছাড়াবে বলে আমার মনে হয় না। দেলওয়ার ভাই এসব মার্কেটিং করেন না। ইচ্ছে করলেই পারেন। কিন্তু করবেন না। আমি জানি এ শহরে এখনো একজন সম্পাদক আছেন যিনি নিজ উদ্যোগে নবীন, প্রবীণদের লেখা জোগাড় করে পড়েন, ভালো লাগলে তার পত্রিকায় লেখার আমন্ত্রণ জানান এবং নিজের পত্রিকাকে দিয়ে কোনো কিছু ম্যানিপুলেশন করতে চান না। এই লেখার উদ্দেশ্য এই কথাটাই বলা, দেলওয়ার ভাইকে তার যাত্রায় অভিনন্দিত করার চেষ্টা করা, যেন তার ক্লান্তি না আসে, যেন আমাদের লেখার জায়গা দিনে দিনে আরো সংকুচিত না হয়ে আসে।
তারিক টুকু
প্রকাশিত বই :
বিস্মৃতি ও বিষাদটিলা [কবিতা; সংবেদ, ২০১২]
ই-মেইল : tariquetuku@gmail.com
Latest posts by তারিক টুকু (see all)
- কবিতাপত্র : একটি স্নিগ্ধ ছাতিমগাছ - November 28, 2019
- গালিবের ক্রমশ বদলে যাওয়া - February 16, 2018