
কোনো কোনো পাঠকদের হয়তো মনে থাকতে পারে যে এর আগে ২০১৩ সালে প্রকাশিত ‘অক্তাবিও পাসের রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে বলেছিলাম তিনি কেবল রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে প্রবন্ধই লেখেন নি, বিভিন্ন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তার অভিমতও জানিয়েছেন; কখনো কখনো ভিন্ন কোনো প্রসঙ্গে রচিত প্রবন্ধে, কখনো-বা আলাপচারিতায়। ইন লাইট অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ এসেছিল গান্ধীর ব্যক্তিত্বের সাথে তুলনা করতে গিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার প্রধান আকর্ষণ সাহিত্যের চেয়ে বরং চিত্রকলার জন্যেই বেশি। তবে তার অর্থ এই নয় যে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক গুরুত্ব তার কাছে মোটেই ছিল না। রবীন্দ্র-কাব্যে কখনো কখনো অতিকথন ও বিগত-রুচির উদ্বোধনে পাস বিমুখ বোধ করলেও, রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতা ও ভাবুকতার সবর্জনীনতাকে কেবল কাব্যমূল্যেই নয়, দূরদর্শিতার কারণেও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন।
চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের কাজ যা ভিক্টর উগোর মতোই কৌতূহলোদ্দীপক।
দূরবর্তী দুই ভিন্ন কারণেই রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি পাসের সাহিত্যিক জীবনে ছিল স্বাভাবিক। ১৯১৮ সালে মেহিকোতে পেদ্রো রেকেনা লেগাররেতার অনুবাদে গীতাজ্ঞলি, কিংবা হোসে বাস্কনসেলোস-এর উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের লা লুনা নুয়েবা (নতুন চাঁদ), নাসিওনালিজমো (জাতীয়তাবাদ), পেরসোনালিদাদ (ব্যক্তিত্ব) ও সাধনা নামক চারটি গ্রন্থ একত্রে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৪ সালে। পাসের বয়স তখন ১০। এরপর আরও বহুজনের অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের বহু গ্রন্থ অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে—স্পানঞা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশ থেকে—প্রধানত মেহিকো ও আর্হেন্তিনা থেকেই। মহাদেশের দুই প্রান্তে এদুটি দেশের অবস্থানের কারণে ভৌগোলিক দূরত্ব থাকলেও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তাদের মধ্যে একটা জায়গায় মিল এই যে দুই দেশেই রবীন্দ্রনাথ লাতিন আমেরিকার অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি মনোযোগ কেড়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে সর্বাধিক চর্চা ও অনুবাদ এ দুটো দেশেই হয়েছে। কেবল অনূদিতই হয় নি, রবীন্দ্রনাথ মেহিকোতে স্কুল পাঠ্যপুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বিশের দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক দশক পর্যন্ত। ফলে, রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে অক্তাবিও পাসের পরিচয় শৈশবেই ঘটেছিল বলে অনুমান করা যায়, যদিও তিনি সেই পরিচয়ের কথা কোথায়ও উল্লেখ করেন নি। অনেক পরে, পরিণত বয়সে রবীন্দ্র-পাঠের অভিজ্ঞতার কথা তিনি জানিয়েছেন প্রথমত রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা বিষয়ক এক প্রবন্ধে, আরও পরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি সে রকমই এক সাক্ষাৎকার নজরে এলো, যেখানে পাস রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা বিষয়ে তার সপ্রশংস অভিমত জানিয়েছেন। ‘আর্তে দে মেহিকো’ নামের শিল্পকলা বিষয়ক এক পত্রিকায় বেরিয়েছিল এই সাক্ষাৎকারটি। আমি কেবল এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের রবীন্দ্র-বিষয়ক অংশটুকু এখানে পাঠকদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য তুলে দিচ্ছি :
‘মনে হয় কোনো কোনো শিল্পীর মূল কাজের পাশে তাদের অন্য কিছু কাজ সাধারণত খুবই, বা তারচেয়েও বেশি কৌতূহলোদ্দীপক। আমরা এর আগে অন্যত্র ভিক্টর উগোর ড্রয়িংগুলো নিয়ে কথা বলেছিলাম, যিনি মহৎ কবি হওয়া সত্ত্বেও ছিলেন এক মহান শিল্পী। তবে আরেকটি লক্ষণীয় ঘটনা আছে যা ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ঘটেছে। আমার স্ত্রী ও আমি যখন কোলকাতায় ছিলাম, তখন রবীন্দ্রনাথের এক শিষ্যা আমাদেরকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন যিনি রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কাগজপত্র সংরক্ষণ করে রাখতেন। তার ঘরটা ছিল এক রকম স্মৃতিশালার মতো, সেখানেই দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের কাজ যা ভিক্টর উগোর মতোই কৌতূহলোদ্দীপক। তার ক্ষেত্রে একটা বিশেষত্ব হলো এই যে, রবীন্দ্রনাথ যে-ভাষায় লিখতেন তাকে বলা হয় দেবনাগরী, এর লেখ্যরূপ খুবই সুন্দর। তবে হ্যাঁ, দাগ কাটতেন, সংশোধন করতেন, মুছে ফেলতেন এবং দাগগুলোকে রূপান্তরিত করতেন। কংক্রিট কবিতা যে-কাজটা করে অনেকটা সেরকম, তবে তিনি এটা করতেন অনেক বেশি প্রকাশবাদী (Expresionista) ভঙ্গিতে যা আমাদের চেনা বহু কংক্রিট কবিদের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত। এবং হঠাৎ করেই অক্ষরগুলো দিয়ে তিনি সৃষ্টি করতেন অসামান্য ভূদৃশ্য আর কাল্পনিক ও ভয়ংকর জীবজন্তু। বিক্তোরিয়া ওকাম্পোও এই পাণ্ডুলিপিগুলো দেখেছিলেন, যখন রবীন্দ্রনাথ তার সান ইসিদ্রোর বাসায় ছিলেন। আঁদ্রে জিদের পৃষ্ঠপোষকতায় রবীন্দ্রনাথ প্যারিসে একটা প্রদর্শনী করেছিলেন। শিল্পকর্ম, চিত্রকলা এবং লেখা যেখানে একে অপরের সাথে জড়িয়ে গেছে সে-ধরনের কাজগুলোর প্রতি আমার সবসময়ই আগ্রহ তৈরি হয়েছে।’
চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের পরিচয়টি এখনও অন্য পরিচয়গুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে-পড়া বলে মনে হয়
খেয়ালি ছন্দে রচিত রবীন্দ্রনাথের এই মাতাল চিত্রকর্মগুলো সম্পর্কে পাসের এই উক্তির সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে পড়বে চিত্রকলা সম্পর্কে তার প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের কথা যা তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল মার্সেল দুসাম্প সম্পর্কে Marcel Duchamp : Appearance shipped Bare একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনায়। তারও অনেক পরে, ১৯৮৭ সালে বেরিয়েছিল Essays on Mexican Art নামের এক গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা সম্পর্কে পাসের প্রবন্ধ এবং পরবর্তীকালে তার বিভিন্ন মন্তব্য যে কোনো ঝোঁকের বশে বা হুজুগে নয়, বরং চিত্রকলা সম্পর্কে তার সুগভীর পাণ্ডিত্য ও উপলব্ধি থেকে উৎসারিত তা সেই পূর্বোক্ত প্রবন্ধ থেকেই বুঝা যায়। তিনি শিল্পকলার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মের স্বতন্ত্র স্পন্দন ও আত্মার আশ্চর্যকে শনাক্ত করেছিলেন। সেই বিশ্লেষী প্রবন্ধে তিনি যে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের হৃদয়গ্রাহী পাণ্ডুলিপি আমাদের কাছে এমন এক শিল্পীকে তুলে ধরে, যিনি একই সঙ্গে আমাদের পূর্বসূরী ও সমকালীন। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাণ্ডুলিপি, এল সিগনো ই এল গারাবাতো, ১৯৭৩), তখন তিনি মোটেই বাড়িয়ে বলেন না, বরং রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার অপেক্ষাকৃত আচ্ছাদিত ও অনালোকিত দিকটিকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন বহুমুখী প্রতিভার বহুবর্ণিল রূপটিকে।
রবীন্দ্রনাথের বহুবিধ পরিচয়ের কথা সারা বিশ্ব জানলেও, চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের পরিচয়টি এখনও অন্য পরিচয়গুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে-পড়া বলে মনে হয়, তা সে ইউরোপেই হোক, কি এশিয়াতেই হোক। লাতিন আমেরিকাতেও কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, শিক্ষাগুরু হিশেবে তার বিপুল পরিচিতি থাকলেও চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে অক্তাবিও পাস ছাড়া আর কেউ লেখেন নি। লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্র-পরিচয়ের এই অপূর্ণ দিকটিকে অক্তাবিও পাস তার অসামান্য শিল্পবোধ দিয়ে পূরণ করেছিলেন।
রাজু আলাউদ্দিন
প্রকাশিত বই :
অনূদিত কাব্যগ্রন্থ—
গেয়র্গ ট্রাকলের কবিতা (মঙ্গলসন্ধ্যা প্রকাশনী, ১৯৯২)
সি পি কাভাফির কবিতা (শিল্পতরু প্রকাশনী, ১৯৯৪)
টেড হিউজের নির্বাচিত কবিতা (বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪)
আকাশের ওপারে আকাশ (দেশ প্রকাশন, ১৯৯৯)
অনূদিত সাক্ষাৎকার গ্রন্থ—
সাক্ষাৎকার (দিব্যপ্রকাশ, ১৯৯৭)
কথোপকথন (বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭)
অনূদিত কথাসমগ্র ( কথাপ্রকাশ)
সংকলন, সম্পাদনা ও অনুবাদ—
মেহিকান মনীষা: মেহিকানো লেখকদের প্রবন্ধের সংকলন (সাক্ষাৎ প্রকাশনী, ১৯৯৭)
খ্যাতিমানদের মজার কাণ্ড (মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৭)
হোর্হে লুইস বোর্হেস: নির্বাচিত গল্প ও প্যারাবল (ঐতিহ্য প্রকাশনী, ২০১০)
হোর্হে লুইস বোর্হেস: নির্বাচিত কবিতা (ঐতিহ্য প্রকাশনী, ২০১০)
হোর্হে লুইস বোর্হেস: নির্বাচিত সাক্ষাতকার (ঐতিহ্য প্রকাশনী, ২০১০)
হোর্হে লুইস বোর্হেস: নির্বাচিত প্রবন্ধ ও অভিভাষন (ঐতিহ্য প্রকাশনী, ২০১০)
প্রসঙ্গ বোর্হেস: বিদেশি লেখকদের নির্বাচিত প্রবন্ধ (ঐতিহ্য প্রকাশনী, ২০১০)
রবীন্দ্রনাথ: অন্য ভাষায় অন্য আলোয় (সংহতি প্রকাশনী, ২০১৪)
মারিও বার্গাস যোসার জীবন ও মিথ্যার সত্য (সাক্ষাৎ প্রকাশনী, ২০১৫)
গৃহীত সাক্ষাৎকার—
আলাপচারিতা ( পাঠক সমাবেশ, ২০১২)
কবিতা—
আকাঙ্ক্ষার মানচিত্র গোপনে এঁকেছি (শ্রাবণ প্রকাশনী, ২০১৪)
জীবনী—
হোর্হে লুইস বোর্হেসের আত্মজীবনী (সহ-অনুবাদক, সংহতি প্রকাশনী, ২০১১)
প্রবন্ধ—
দক্ষিণে সূর্যোদয়: ইস্পানো-আমেরিকায় রবীন্দ্র-চর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস( অবসর প্রকাশনী, ২০১৫)
ই-মেইল : razualauddin@gmail.com
Latest posts by রাজু আলাউদ্দিন (see all)
- সে ভাষা ভুলিয়া গেছি - October 25, 2019
- বাংলাদেশের রূপান্তর, ধর্মীয় অনুভূতির ভণ্ডামি ও সরকারের অপরাধসমূহ - June 3, 2019
- বই থেকে : আকাশের ওপারে আকাশ - February 13, 2019