
‘যখন হৃদয় কোনো বিশেষ ভাবে আচ্ছন্ন হয়—স্নেহ, কি শোক, কি ভয়, কি যাহাই হউক, তাহার সমুদয়াংশ কখনো ব্যক্ত হয় না। কতকটা ব্যক্ত হয় কতকটা ব্যক্ত হয় না। যাহা ব্যক্ত হয় তাহা ক্রিয়ার দ্বারা বা কথার দ্বারা।’
—বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
আর যেটুকু অব্যক্ত, সচরাচর অদৃষ্ট, অদর্শনীয় এবং অন্যের অননুমেয় অথচ ভাবাপন্ন, ব্যক্তির হৃদয়মধ্যে উচ্ছ্বসিত, তাকে ব্যক্ত করার কৌশলকেই কি কবিতা বলা যেতে পারে?
এমনটাই হয় যে, আমরা কোনো বস্তুর প্রতিরূপ দেখে আনন্দ পাই তার কারণ ঐ দেখার মধ্য দিয়ে দৃষ্ট বস্তু সম্পর্কে একটা জ্ঞানলাভ করি। আমরা বেদনা বোধ করি যেমন কদাকার প্রাণী ও শবদেহ দেখে, তেমনি তার নিখুঁত অনুকৃতির দিকে তাকিয়ে আমরা আনন্দ উপভোগ করি। মনে মনে আমরা প্রতিটি বস্তু-প্রতিরূপের অন্তর্লীন তাৎপর্য খুঁজতে খুঁজতে সেই বস্তুটির একটা পূর্ণাঙ্গ আভাস আবিষ্কার করি। কদাচ এর ব্যতিক্রম হলে এক ফাঁপা, শূন্য, অর্থহীন (?) নৈঃশব্দ্যের সৃষ্টি হয়।
তার কবিতা যেমন সংশয় ও সংকট উভয়ই ধরে আছে, তেমনই সম্ভাবনার জায়গাটিও অনেক বেশি।
একটা গ্রন্থে কী থাকে আশলে! একটা সময়খণ্ডই তো! এই টাইমটা যার ভেতর দিয়ে যে-রূপে প্রবাহিত হয় সাধারণত তারই বিচ্ছুরণ আমরা ধরতে চেষ্টা করে থাকি। সময়ের এই নির্মাণ-কৌশল ভিন্ন হতে পারে, ভিন্ন হতে পারে তার আকৃতি। হাসান রোবায়েত কবিতা নতুন স্টাইলে লেখেন নাই, তবে চেষ্টা করেছেন; যদিও তার পূর্বসূরি নাই, তবে দীক্ষাটা অগ্রজদের কাছ থেকেই পাওয়া। তার কবিতা যেমন সংশয় ও সংকট উভয়ই ধরে আছে, তেমনই সম্ভাবনার জায়গাটিও অনেক বেশি।
যা কিছু সুন্দর, তা কোনো প্রাণীই হোক বা বিভিন্ন অঙ্গের যথাযথ সংস্থানের ফলে সৃষ্ট একটি বস্তুসমগ্রই হোক, তাকে শুধু অঙ্গবিন্যাসের দিক থেকেই সুসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে তা-ই নয়, তা একটি সুনির্দিষ্ট আয়তনও দাবি করে। কারণ সমগ্র বলতে আমি তাই বুঝি যার আদি, মধ্য, অন্ত আছে। কেননা সুগঠিত বৃত্ত তাই, যা যেখানে-সেখানে শুরু হতে পারে না, আর যেখানে-সেখানে শেষও হতে পারে না। রোবায়েতের কবিতার সংকট ও সম্ভাবনা মনে হয় এখানেই।
ক. বীজের গোপন থেকে ফিরে আসে পাখিদের হাওয়া
খ. দুপুরে নিমগাছ এলে…
গ. ঈষৎ রাক্ষস শুধু হেলে পড়ে ঘুঘুদের জ্বরে
কয়েকটা উদাহরণ দিলাম। আপাত দৃষ্টিতে এই। এই চিত্রকল্প, দৃশ্যকল্প এই বিমূর্তায়ন কী অর্থ বহন করে? বা কতটুকু বহন করে? বা আদৌ কোনো অর্থ বহন করে কি? ঘটনার সম্ভাব্যতা কিংবা আবশ্যিকতার সূত্রাবলীরই বা কতটুকু দেখা পাচ্ছি আমরা রোবায়েতে!
আমার মনে হয়েছে এ এক অপার শূন্যতা। এবং তার থেকে আরও কোনো এক মহাশূন্যের দিকে জার্নি। সম্ভাব্যতা অথবা আবশ্যিকতার নিয়মের অধীন হয়েও ঘটনাকে পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারছে না। ফলে তৈরি হচ্ছে সংকট। ফলে কোনো বাণীদেহ নির্মাণ-পরবর্তীকালে একটা পূর্ণাঙ্গ ভিউ তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সৃষ্ট চরিত্রগুলোর সাথে পাঠক একাত্ম হতে পারছেন না।
তবে রোবায়েতের যে-দিকটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো ভাষার দক্ষতা―বাক্যকে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে সাজানোর ক্ষমতা আছে তার।
ক. দণ্ডিত পালকের নিচে সামান্য ময়ূর
খ. পাতা, তুমিও ঝরাও বিপুল
একা ময়ূরতা
বাক্য দুটিতে ‘ময়ূর’ নাম শব্দটি দুই ভাবে এসেছে। ‘সামান্য ময়ূর’ আদতে এর আকৃতি, রূপ বা গুণের প্রকাশ―যে-কোনো একটি হতে পারে। আবার ‘খ’ এর বাক্যটিতে বিশেষ্য ‘ময়ূর’ শব্দটিকে বিশেষণ হিশেবে ইউজ করা হয়েছে। এমন ব্যাকরণ-বিপর্যয় রোবায়েতে পাওয়া যাবে বেশ কিছু পঙ্ক্তিতে, যেখানে বাংলা বাক্যের প্রথাগত সিন্ট্যাক্স পর্যুদস্ত হয়েছে নানান ভাবে; পাঠের অভিনিবেশে তা ধরা পড়বে বিভিন্ন বাক্যে অথচ সে-সব হয়ে উঠেছে কবিতা। একই আভাস পাই তার এই পঙ্ক্তিগুলোয়—
এইখানে এই নিখিল ফার্নের দেশে
ব্যাকরণ-নিরীহ এসে বলে যায়
‘তুমি যাকে রোববার ভাবো আসলে সে এক
নীল কাকের ঘর।
শিটমেটালের পাশেই আমাদের অস্ফুট চক্রবাল’।
দৃষ্টি-সীমার বাইরে গিয়েও আলাদা এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে তার ভাষা।
কিছু বাক্যের গভীরতা এতটাই যে, হতভম্ব হয়ে যেতে হয়—
ক.
তারারা অস্ত গেলে
পাতায় শুয়ে থাকে আপেলের হাওয়া
বহুকাল অচল ধাতবের দিকে।
খ.
যে হাসি অশ্বের আড়াল হয়ে ফুটে আছে ধীর
গ.
কতদূর অশ্বের দিকে যাওয়া যায় একটি জীবনী-পাঠে!
আরও বলা যায়। এই পঙ্ক্তিগুলো যে-দ্যোতনা সৃষ্টি করে, মনে হয় তাদের জন্ম অন্য কোনো লোকে। আমাদের সমসাময়িক অন্যান্যদের থেকে হাসান এগিয়ে এইখানে। ভাষাকে যেমন ভেঙেছেন, তেমনি গড়েছেনও। কখনও পাঠককে স্থিতি দিয়েছেন কখনও বা অস্থির করে তুলেছেন। তার দৃষ্টি সুদূর-প্রসারী। মনে হয়, দৃষ্টি-সীমার বাইরে গিয়েও আলাদা এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে তার ভাষা। কখনও আমরা চিনে উঠতে পারছি না তাকে। তার ভাষা আঙ্গিকের চরম বদল ঘটিয়ে তাকে মহাকোলাহলের কাছাকাছি এনেছে কখনও কখনও। সৃষ্টি করেছে অন্ধকার, বিচ্ছিন্নতা। মনের রহস্যময় গভীরতায় যুক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে তৈরি করেছে প্রতীকের সৌন্দর্য। যে-সৌন্দর্য নিয়মের ভেদরেখা লুপ্ত করে নতুন অ্যাসথেটিকসের দিকে ধাবিত হয়েছে, ইন্দ্রিয়ে চরম বিপর্যয় ঘটিয়ে তৈরি করেছে নতুন ডিসকোর্স।
অনুপম মণ্ডল
প্রকাশিত বই :
ডাকিনীলোক [কবিতা, চৈতন্য, ২০১৬]
ই-মেইল : anupamsoc@gmail.com
Latest posts by অনুপম মণ্ডল (see all)
- অহম ও অশ্রুমঞ্জরী - April 14, 2017
- কবিতার বইগুলো : ৫ম পর্ব - January 12, 2017
- কবিতার বইগুলো : ৪র্থ পর্ব - January 2, 2017